পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গঠন

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গঠন

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গঠন সম্পর্কে আমরা ভূগোল থেকে জানতে পারি। সৃষ্টির শুরুতে পৃথিবী ছিল এক উত্তপ্ত গ্যাসপিন্ড। এই গ্যাসপিন্ড ক্রমে ক্রমে শীতল হয়ে ঘনীভূত হয়।

এ সময় এর উপর যে আস্তরণ পড়ে তা হলো ভূত্বক। ভূগর্ভের রয়েছে তিনটি স্তর।

১. অশ্মমন্ডল

২. গুরুমন্ডল

৩. কেন্দ্রমন্ডল

ভূত্বক যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি তার সাধারণ নাম শিলা। পৃথিবীতে কার্যরত বিভিন্ন ভূমিরূপ প্রক্রিয়া শিলা ও খনিজের ধরণ দ্বারা প্রভাবিত হয়। ভৃপৃষ্ট সর্বদা পরিবর্তনশীল।

এ পরিবর্তন দুরকম। ধীর পরিবর্তন ও আকস্মিক পরিবর্তন। এ অধ্যায়ে আমরা পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক গঠন, বিভিন্ন রকম শিলা, ভৃপৃষ্টের ধীর ও আকস্মিক পরিবর্তন এবং

বিভিন্ন ভূমিরূপ নিয়ে আলোচনা করব।

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন

সৃষ্টির সময় পৃথিবী ছিল একটি উত্তপ্ত গ্যাসপিন্ড। উত্তপ্ত অবস্থা থেকে এটি শীতল ও ঘনীভূত হয়। এই সময় পৃথিবীর বাইরের ভারী উপাদানগুলো এর কেন্দ্রের দিকে জমা হয়।

আর হালকা উপাদানগুলো ভরের তারতম্য অনুসারে নিচের থেকে উপরে স্তরে স্তরে জমা হয়। পৃথিবীর এই বিভিন্ন স্তরকে মন্ডল বলে।

উপরের স্তরটিকে অশ্মমন্ডল বলে। অশ্মমন্ডলের উপরের অংশ ভূত্বক নামে পরিচিত।

পৃথিবীর গঠন প্রণালীতে ভূত্বক কী

ভূপৃষ্টে শিলার যে কঠিন বহিবারবরণ দেখা যায় তাই ভূত্বক। ভূঅভ্যন্তরের অন্যান্য স্তরের তুলনায় ভূত্বকের পুরুত্ব সবচেয়ে কম; গড়ে ২০ কিলোমিটার।

ভূত্বক মহাদেশের তলদেশে গড়ে ৩৫ কিলোমিটার এবং সমুদ্র তলদেশে তা গড়ে ৫ কিলোমিটার পুরু। সাধারণভাবে মহাদেশীয় ভূত্বকের এ স্তরকে সিয়াল স্তর বলে।

যা সিলিকন ও অ্যালুমিনিয়াম দ্বারা গঠিত, যা সিয়াল স্তরের তুলনায় ভারী এবং এর প্রধান খনিজ উপাদানের সিলিকন ও ম্যাগনেসিয়াম যা সাধারণভাবে সিমা নামে পরিচিত।

অনুমান করা হয় যে, এ ব্যাসল্ট স্তরই সারা পৃথিবী জুড়ে বাহিরাবরণ ও গভীর সমুদ্র তলদেশে বিদ্যমান। ভূত্বকের উপরের ভাগেই বাহ্যিক অবয়বগুলো দেখা যায়।

যেমন- পর্বত, মালভূমি, সমভূমি ইত্যাদি। ভূত্বকের নিচের দিকে প্রতি কিলোমিটারে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ে।

গুরুমন্ডল

ভূত্বকের নিচে প্রায় ২,৮৮৫ কিলোমিটার পর্যন্ত পুরুমন্ডলকে গুরুমন্ডল বলে। গুরুমন্ডল মূলত ব্যাসল্ট শিলা দ্বারা গঠিত। এ অংশে রয়েছে সিলিকা, ম্যাগনেসিয়াম, লোহা, কার্বন ও অন্যান্য খনিজ পদার্থ।

গুরুমন্ডল দুই ভাগে বিভক্ত। (ক) ঊর্ধ্ব গুরুমন্ডল যা ৭০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই মন্ডল প্রধানত লোহা ও ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ সিলিকেট খনিজ দ্বারা গঠিত।

(খ) নিম্ন গুরুমন্ডল প্রধানত আয়রন অক্সাইড, ম্যাগনেসিয়াম অক্সাইড এবং সিলিকন ডাইঅক্সাইড সমৃদ্ধ খনিজ দ্বারা গঠিত।

কেন্দ্রমন্ডল

গুরুমন্ডলের ঠিক পরে রয়েছে কেন্দ্রমন্ডল। গুরুমন্ডলের নিচ থেকে পৃথিবীর কেন্দ্র পর্যন্ত এই মন্ডল বিস্তৃত। এ স্তর প্রায় ৩,৪৮৬ কিলোমিটার পুরু। ভূকম্পন তরঙ্গের সাহায্যে জানা গেছে যে,

কেন্দ্রমন্ডলের একটি তরল বাহিরাবরণ আছে, যা প্রায় ২,২৭০ কিলোমিটার পুরু এবং একটি কঠিন অন্তঃভাগ আছে, যা ১,২১৬ কিলোমিটার পুরু। বিজ্ঞানীগণ বিশ্বাস করেন যে,

কেন্দ্রমন্ডলের উপাদানগুলোর মধ্যে লোহা, নিকেল, পারদ ও সিসা রয়েছে। তবে প্রধান উপাদান হলো নিকেল ও লোহা।

শিলা ও খনিজ

ভূত্বক শিলা দ্বারা গঠিত। শিলা বিভিন্ন খনিজের সংমিশ্রণে গঠিত। জানা যাক, খনিজ বলতে কী বোঝায়? শিলা ও খনিজের পাথ্যক্য কী? কতকগুলো মৌলিক উপাদান প্রাকৃতিক উপায়ে মিলিত হয়ে

যে যৌগ গঠন করে তাই খনিজ। খনিজ হলো একটি প্রাকৃতিক অজৈব পদার্থ যার সুনির্দিষ্ট রাসায়নিক গঠন এবং ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম রয়েছে। আর শিলা হলো এক বা একাধিক খনিজের মিশ্রণ।

খনিজ দুই বা ততোধিক মৌলের সমন্বয়ে গঠিত হলেও কিছু কিছু খনিজ একটি মাত্র মৌল দ্বারাও গঠিত হতে পারে। যেমন হীরা, সোনা, তামা, রূপা, পারদ ও গন্ধক।

শিলা গঠনকারী প্রতিটি খনিজের আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য বজায় থাকে। যদিও বেশিরভাগ শিলাই একাধাকি খনিজ দ্বারা গঠিত হয়। সে ক্ষেত্রে খনিজ এবং শিলা একই পদার্থ।

উদাহরণ হলো, পাললিক শিলা চুনাপাথর। এটি ক্যালসাইট নামের একটি খনিজ। শিলা হিসেবে এটি চুনাপাথর নামে পরিচিত।

আগ্নেয় শিলা

জন্মের প্রথমে পৃথিবী একটি উত্তপ্ত গ্যাসপিন্ড ছিল। এই গ্যাসপিন্ড ক্রমান্বয়ে তাপ বিকিরণ করে তরল হয়। পরে আরও তাপ বিকিরণ করে এর উপরিভাগ শীতল ও কঠিন আকার ধারণ করে।

এভাবে গলিত অবস্থা থেকে ঘনীভূত বা কঠিন হয়ে যে শিলা গঠিত হয় তাকে আগ্নেয় শিলা বলে। আগ্নেয় শিলা পৃথিবীর প্রথম পর্যায়ে সৃষ্টি হয় তাই এই শিলাকে প্রাথমিক শিলাও বলে।

এ শিলায় কোনো স্তর নেই। তাই আগ্নেয় শিলার অপর নাম অস্তরীভূত শিলা। এই শিলায় জীবাশ্ন নেই। এই শিলার বৈশিষ্ট্য হলো- স্ফটিকাকার, অস্তরীভূত, কঠিন ও কম ভঙ্গুর, জীবাশ্ন দেখা যায় না

এবং অপেক্ষাকৃত ভারী।

আগ্নেয়গিরি বা ভূমিকম্পের ফলে অনেক সময় ভূত্বকের দুর্বল অংশে ফাটলের সৃষ্টি হয়। তখন পৃথিবীর অব্যন্তর থেকে উত্তপ্ত গলিত লাভা নির্গত হয়ে আগ্নেয় শিলার সৃষ্টি করে।

এভাবে ব্যাসল্ট ও গ্রানাইট শিলার সৃষ্টি হয়। আগ্নেয় শিলাকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যথা- বহিঃজ আগ্নেয় শিলা ও অন্তঃজ আগ্নেয় শিলা।

ভূপৃষ্ঠের পরিবর্তন প্রক্রিয়া

ভূপৃষ্ট সর্বদা পরিবর্তনশীল। নানাপ্রকার ভূপ্রক্রিয়া ভূপ্রষ্ঠের পরিবর্তন সাধন করে। যে সমস্ত কার্যাবলির কারণে প্রাকৃতিকভাবে ভূমিরূপের পরিবর্তন সাধিত হয় তা ভূপ্রক্রিয়া।

যেমন- নদী অবক্ষেপণের মাধ্যমে প্লাবন ভূমি গড়ে তুলেছে। এখানে নদী অবক্ষেপণ একটি প্রক্রিয়া। ভূতাপীয় শক্তি এবং সৌরশক্তি। এ সমস্ত শক্তির সাহায্যে ভূপ্রক্রিয়া ভূপৃষ্ঠের কোথাও ধীরে ধীরে

পরিবর্তন আনে, আবার কখনো কখনো খুব দ্রুত পরিবর্তন আনে। সুদীর্ঘ সময় ধরে ভূপৃষ্ঠে এই পরিবর্তন চলে বিধায় একে ধীর পরিবর্তন বলে।

ধীর পরিবর্তন সাধারণত দুটি প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়। যেমন নগ্নীভবন ও অবক্ষেপণ। অপরদিকে অন্তঃশক্তির সঙ্গে জড়িত ভূপ্রক্রিয়ায় ভূপৃষ্ঠে দ্রুত পরিবর্তন সাধিত হয়।

ভূমিকম্প কী?

পৃথিবীর কঠিন ভূত্বকের কোনো কোনো অংশ প্রকৃতিক কোনো কারণে কখনো কখনো অল্প সময়ের জন্য হঠাৎ কেঁপে ওঠে। ভূত্বকের এরূপ আকস্মিক কম্পনকে ভূমিকম্প বলে। ভূকম্পন সাধারণত

কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী হয় আবার কিছু কিছু সময় পর পর অনুভূত হয়। এ কম্পন কখনো কখনো অত্যন্ত মৃদু আবার কখনো অত্যন্ত প্রচন্ড হয়।

ভূমিকম্পের প্রধান কারণঃ পৃথিবীর উপরিভাগ কতগুলো ফলক/প্লেট দ্বারা গঠিত। এই প্লেটসমূহের সঞ্চালন প্রধানত ভূমিকম্প ঘটিয়ে থাকে।

অগ্ল্যুৎপাতের ফলে প্লেটসমূহের উপর ভূকম্পন সৃষ্টি হয়।

ভূমিকম্পের ফলাফলঃ ভূমিকম্পের ফলে ভূপৃষ্ঠের অনেক ধরনের পরিবর্তন ঘটে এবং বহু ধ্বংসলীলা সাধিত হয়। ঘরবাড়ি, ধনসম্পদ ও যাতায়াত ব্যবস্থা বিনষ্ট হয়।

এতে জীবনেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়ে থাকে। ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকের মধ্যে অসংখ্য ভাঁজ, ফাটল বা ধসের সৃষ্টি হয়। নদীর গতিপথ পাল্টে যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৯৮৭ সালে

আসামে যে ব্যাপক ভূমিকম্প হয় তাতে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তলদেশ কিছুটা উচু হয়ে যায়। ফলে নদটি তার গতিপথ পাল্টে বর্তমানে যমুনা নদী দিয়ে প্রবাহিত হতে শুরু করে।

আরও পড়ুন

 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url