মহাকর্ষ কাকে বলে? ছাত্রদের জন্য সহজ ব্যাখ্যা

মহাকর্ষ কাকে বলে? ছাত্রদের জন্য সহজ ব্যাখ্যা

মহাকর্ষ বা অভিকর্ষ হলো প্রকৃতির একটি মৌলিক শক্তি যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। এই বলের কারণেই আমরা পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি, গাছ থেকে ফল নিচে পড়ে এবং চাঁদ পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। কিন্তু মহাকর্ষ আসলে কী? এটি কীভাবে কাজ করে? এই নিবন্ধে আমরা সহজ ভাষায় মহাকর্ষের ধারণা, এর গুরুত্ব এবং এর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নিয়ে আলোচনা করব।

মহাকর্ষের সংজ্ঞা

মহাকর্ষ (Gravity) হলো একটি আকর্ষণ শক্তি যা দুটি বস্তুর মধ্যে কাজ করে। এই শক্তি বস্তুর ভর এবং তাদের মধ্যকার দূরত্বের উপর নির্ভর করে। মহাকর্ষের সবচেয়ে সাধারণ উদাহরণ হলো পৃথিবী আমাদেরকে তার দিকে আকর্ষণ করে, যার কারণে আমরা মাটিতে পড়ে না গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি।


মহাকর্ষের সহজ উদাহরণ

  •  একটি ফল গাছ থেকে নিচে পড়ে।
  •  নদীর পানি সমুদ্রের দিকে প্রবাহিত হয়।
  •  আমরা লাফ দিলে আবার মাটিতে ফিরে আসি।

মহাকর্ষের আবিষ্কার ও নিউটনের সূত্র

মহাকর্ষ সম্পর্কে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা দেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। কিংবদন্তি অনুসারে, একটি আপেল গাছ থেকে পড়তে দেখে তিনি মহাকর্ষের ধারণা পেয়েছিলেন।

নিউটনের মহাকর্ষ সূত্র

নিউটনের সার্বজনীন মহাকর্ষ সূত্র অনুযায়ী:

"বিশ্বের প্রতিটি বস্তুকণা একে অপরকে নিজের দিকে আকর্ষণ করে এবং এই আকর্ষণ বল বস্তুদ্বয়ের ভরের গুণফলের সমানুপাতিক ও তাদের মধ্যকার দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক।"

গাণিতিক রূপ:

F=Gm1m2r2F=Gr2m1m2

যেখানে:
  •  FF = মহাকর্ষ বল
  •  GG = মহাকর্ষ ধ্রুবক (6.674×10−11 Nm2/kg26.674×10−11Nm2/kg2)
  •  m1,m2m1,m2 = দুটি বস্তুর ভর
  •  rr = বস্তুদ্বয়ের মধ্যকার দূরত্ব

আধুনিক বিজ্ঞানে মহাকর্ষ: আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব

নিউটনের সূত্র মহাকর্ষের একটি ভালো ব্যাখ্যা দিলেও, আলবার্ট আইনস্টাইন তার সাধারণ আপেক্ষিকতা তত্ত্ব-এ মহাকর্ষকে আরও গভীরভাবে বর্ণনা করেন। আইনস্টাইনের মতে, মহাকর্ষ কোনো শক্তি নয়, বরং এটি স্থান-কালের বক্রতার ফল।

স্থান-কাল কী?

আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাকাশ কেবল ত্রিমাত্রিক নয়—এটি চতুর্মাত্রিক (দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা + সময়)। কোনো ভারী বস্তু (যেমন সূর্য) স্থান-কালকে বাঁকিয়ে দেয়, এবং এই বক্রতার কারণে অন্যান্য বস্তু (যেমন পৃথিবী) তার চারপাশে ঘুরতে থাকে।

উদাহরণ:

  •  একটি লোফার উপর ভারী বল রাখলে তা লোফাকে বাঁকিয়ে দেয়। যদি একটি ছোট বল লোফার পাশে রাখা হয়, তা বড় বলের দিকে গড়িয়ে যাবে। এটাই স্থান-কালের বক্রতার সরলীকৃত উদাহরণ।

মহাকর্ষের প্রভাব

১. পৃথিবীতে মহাকর্ষের প্রভাব

  •  ওজন: মহাকর্ষের কারণেই আমাদের ওজন হয়। ওজন হলো পৃথিবী আমাদের উপর যে আকর্ষণ বল প্রয়োগ করে তার পরিমাপ।
  •  জোয়ার-ভাটা: চাঁদের মহাকর্ষীয় টানের কারণে সমুদ্রে জোয়ার-ভাটা হয়।

২. মহাকাশে মহাকর্ষের ভূমিকা

  •  গ্রহদের কক্ষপথ: সূর্যের মহাকর্ষের কারণে পৃথিবী ও অন্যান্য গ্রহগুলি তাদের কক্ষপথে ঘোরে।
  •  কালো গহ্বর: অত্যধিক ভরের কারণে কালো গহ্বরের মহাকর্ষ এতটাই শক্তিশালী যে আলোও এর থেকে বের হতে পারে না।

মহাকর্ষ ছাড়া জীবন কেমন হতো?

মহাকর্ষ না থাকলে:

  •  আমরা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ধরে রাখতে পারতাম না।
  •  সমুদ্র, নদী, বৃষ্টিপাত ইত্যাদি থাকত না।
  •  গ্রহ ও নক্ষত্রগুলি গঠিত হতো না।

মহাকর্ষ সম্পর্কিত সাধারণ প্রশ্নোত্তর (FAQ)

১. মহাকর্ষ কি শুধু পৃথিবীতেই আছে?

না, মহাকর্ষ সর্বত্র বিদ্যমান। প্রতিটি বস্তুরই কিছু না কিছু মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র আছে, তবে বৃহদাকার বস্তু (যেমন গ্রহ, নক্ষত্র) এর প্রভাব বেশি অনুভব করা যায়।

২. চাঁদে মহাকর্ষ কেমন?

চাঁদের ভর পৃথিবীর চেয়ে কম, তাই সেখানে মহাকর্ষও দুর্বল। চাঁদে আপনার ওজন পৃথিবীর প্রায় ১/৬ অংশ হবে!

৩. মহাকর্ষ কি আলোর গতিকে প্রভাবিত করে?

হ্যাঁ, আইনস্টাইনের তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাকর্ষ আলোর পথকে বাঁকাতে পারে। এটি গ্র্যাভিটেশনাল লেন্সিং নামে পরিচিত।


উপসংহার

মহাকর্ষ আমাদের মহাবিশ্বের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শক্তি, যা গ্রহ, নক্ষত্র এবং গ্যালাক্সিগুলিকে একত্রে ধরে রাখে। নিউটনের সূত্র থেকে শুরু করে আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব—মহাকর্ষ সম্পর্কে আমাদের বুঝতে পারার ক্ষমতা সময়ের সাথে উন্নত হয়েছে। এই মৌলিক বলটি না থাকলে আমাদের অস্তিত্বই সম্ভব হতো না।

আরও পড়ুনঃ 



Next Post Previous Post